দশমীতে বিসর্জনের মাধ্যমে শেষ হয় বাংলার শ্রেষ্ঠ উৎসব দূর্গাপুজা। দেবী দূর্গা মেয়ে রূপে অশুভ শক্তির বিনাশিনী, মহিষাসুর মর্দিনী এবং সর্বমঙ্গলা রূপে চারদিন পুজো পাবার পর বিজয়া দশমীর দিন তাকে সবাইকে চোখের জলে ভাসিয়ে ফের রওনা হন কৈলাসে পতি গৃহের উদ্দ্যেশ্যে। কিন্তু উত্তরের আম জনতার হৃদয় সায় দেয়না দেবীকে বিদায় দিতে। তাই উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন এলাকায় একাদশীর দিন থেকে তিনদিন আরেক দুর্গাপূজা অনুষ্ঠিত হয়। তবে এখানে দেবী দূর্গারূপে পুজিতা হননা, পূজিতা হন ভান্ডানী দেবী রূপে। জলপাইগুড়ি ও কোচবিহার জেলার আদি বাসিন্দা রাজবংশী সম্প্রদায়ের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে এই পুজো প্রচলিত। বর্তমানে এই পুজোতে সব সম্প্রদায়ের মানুষ সামিল হন। এই পুজোর প্রচলন সম্পর্কে নির্দিষ্ট কোনো তথ্য পাওয়া যায়না। লোকশ্রুতি অনুসারে একেক এলাকায় একেক রকম তথ্য পাওয়া যায়। কোচবিহার জেলার মেখলিগঞ্জের নিজতরফ গ্রামে যে লোকশ্রুতি প্রচলিত তা হল দশমীর দিন দেবী এই গ্রামের উপর দিয়ে পতিগৃহে ফিরছিলেন। তখন দেবীর মালপত্র বাহিকা অসুস্থ হয়ে পড়লে দেবী ঐ গ্রামে অবস্থান করেন এবং গ্রামবাসীদের স্বপ্নাদেশ দেন তার পুজো করতে। মালবাহিকা বা ভান্ডারনীর কাহিনি কে কেন্দ্র করে দেবীর পুজো শুরু হয় বলে দেবী ভান্ডারনী নাম পান, পরে লোকমুখে এই নাম ভান্ডানীতে পরিবর্তিত হয়। এই জেলার মাথাভাঙ্গা মহকুমায় যে কাহিনী প্রচলিত তা হলো দেবী দূর্গা দশমীর দিন ঐ এলাকা দিয়ে পতিগৃহে ফিরে যাবার সময় পতি শিবের ওপর অভিমান করেন যে শিব তাকে তিনদিন বাদেই পিতৃগৃহ থেকে ফিরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।এই অভিমান থেকে দেবী মাথাভাঙ্গা এলাকার রানীরহাট ও পাটছড়া গ্রামে অবস্থান করেন। তখন শিব গ্রামবাসীদের বলেন দেবীর অভিমান ভাঙ্গাতে পুজো করতে। দেবীর অভিমানের ভান করা ও শিবের দ্বারা অভিমান ভাঙ্গানো থেকেই দেবীর নাম হয়েছে ভান্ডানী। জলপাইগুড়ি ও আলিপুরদুয়ার জেলায় যে কাহিনীর প্রচলন আছে তা হলো দেবী পতিগৃহ থেকে মাত্র তিন দিনের জন্য এসে পুজো গ্রহন করেন ফলে অনেক সাধারণ মানুষ বিশেষ করে সমাজের অন্ত্যজ শ্রেনীর মানুষেরা তার পুজো দিতে পারেননা কারন সেই সময়ে দুর্গাপূজা ছিল সমাজের উচ্চ শ্রেনীর মানুষের বৈভব ও সমৃদ্ধি দর্শানোর একটা মাধ্যম। দেবী দূর্গা দশমীর দিন পতিগৃহে ফিরে যাবার সময় এই সাধারন মানুষজন দেবীর পথ আটকে তাদের পুজো নিতে প্রার্থনা জানালে দেবী বলেন দশমী অতিক্রান্ত হওয়ায় তিনি দশভুজা রুপে পুজো নিতে পারবেননা। দেবী তখন চতুর্ভুজা রূপে অন্য দেবীর ভান করে পুজো গ্রহন করেন বলে দেবীর নাম ভান্ডানী। আরও অনেক লোকশ্রুতি রয়েছে এই দেবীর সম্পর্কে। দেবী ভান্ডানী কোথাও চতুর্ভুজা, কোথাও দ্বিভুজা, কোথাও সিংহবাহনা, কোথাও দেবীর সাথে গনেশ, কার্তিক, লক্ষী, সরস্বতী থাকেন আবার কোথাও দেবীর একক মুর্তির পুজো হয়। যাই হোক দেবী ভান্ডানী এখন উত্তরবঙ্গের লৌকিক দেবী রূপে সর্বজন বন্দিতা এবং লোক সংস্কৃতির বাহক ও ধারক রূপেই পূজিতা হন।
Alipurduar: দশমীর পর আরেক দুর্গাপূজা উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন এলাকায়
রিপোর্ট : সুকুমার রঞ্জন সরকার , এই যুগ, আলিপুরদুয়ার