Breaking News

Howrah: সরকারি নীতি ও উদাসীনতায় এককালের শেফিল্ড নগরী হাওড়াতে আজ কর্মহীন বিশ্বকর্মা

রিপোর্ট : শুভাশীষ দত্ত , এই যুগ, হাওড়া

Howrah: সরকারি নীতি ও উদাসীনতায় এককালের শেফিল্ড নগরী হাওড়াতে আজ কর্মহীন বিশ্বকর্মা শিল্পের শহর হাওড়া । যে শহর কলকাতা থেকেও আরো সুপ্রাচীন। হুগলি নদীর তীরে অবস্থিত হওয়ায় একসময় শিল্প-বাণিজ্য সমৃদ্ধ হাওড়া তকমা পেয়েছিল এশিয়ার শেফিল্ড নামে। আর বর্ধিত শিল্পে যুক্ত শ্রমিকদের জন্য ১৮৫৭ সালে শুধুমাত্র হাওড়া শহরের জন্য প্রবর্তিত হয়েছিল “হাওড়া অফেন্স অ্যাক্ট”।ইতিহাসের পাতা ঘাটলে জানা যায়, অধুনা বাংলার প্রধান অন্যতম নদী বাণিজ্যিক বন্দর ছিল বেতড় । অতীতে শিবপুর সংলগ্ন অঞ্চলকে বলা হত বেতড় । সরস্বতী নদীর তীরে বেতড় ছিল এক অস্থায়ী বন্দর। মোগলরা আসার পূর্বেও এখানে পণ্যবোঝাই জাহাজের মাল খালাস হত। ১৭৯৬ সালে সালকিয়ায় একটি জাহাজ নির্মাণ ও মেরামত কেন্দ্র গড়ে ওঠে। ১৮১৭ সালে বাউড়িয়ায় স্থাপিত কটন মিলটি ছিল ভারতের প্রথম কার্পাস বয়ন কারখানা। ১৮৫৪ সালে হাওড়া স্টেশন প্রতিষ্ঠা হলে হাওড়া জেলার শিল্পক্ষেত্রে জোয়ার আসে। বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে ইঞ্জিনিয়ারিং ও ফাউন্ড্রি সহ বিভিন্ন ভারী শিল্পে হাওড়া শহরের উৎকর্ষ ও ব্যাপকতা বিচার করে একে এশিয়ার শেফিল্ড বলা হত ।এক সময় হাওড়া শিল্পাঞ্চলকে বলা হত ‘শেফিল্ড অফ ইস্ট’। মূলত এখানকার ইঞ্জিনিয়ারিং শিল্পের অসংখ্য ছোট বড় কারখানার নাম ছিল গোটা দেশজুড়ে। স্বভাবতই প্রতি বছর বিশ্বকর্মা পুজোর আগে এই সব কারখানায় আয়োজন থাকত তুঙ্গে। জাঁকজমকপূর্ণভাবে পালিত হত বিশ্বকর্মা পুজো। বিশাল আকারের বিশ্বকর্মা মূর্তির পাশাপাশি আলোয় ঝলমল করে উঠত এখানের কারখানাগুলি। শুধু তাই নয়, এই সময়ে কর্মীদের বোনাসও দেওয়া হত। পুজোর দিনে সারাদিন খাওয়া দাওয়া হইহুল্লোড় লেগেই থাকত শিল্পাঞ্চলে।আর এই বছর একাধিক ব্যবসায়ীরাই এবার ছোট আকারের বিশ্বকর্মার মূর্তি অর্ডার দিয়েছেন। কেউ কেউ ঘটপুজো করার ভাবনায়। যার প্রত্যক্ষ প্রভাব পড়েছে মৃৎশিল্পেও।হাওড়া শিল্পাঞ্চলেও এবছর মন্দার কারণে আকারে প্রায় অর্ধেক হয়ে গেছে বিশ্বকর্মার মূর্তি। কঠিন পরিস্থিতি প্রতিমা তৈরির গোলাগুলিতেও। অন্যান্য বছরের তুলনায় এবারে অর্ডারের সংখ্যা অনেকটাই কম। বিভিন্ন ছোট কারখানার মালিকেরা জানাচ্ছেন, করোনা আবহে কার্যত লকডাউনের জেরে এবছরে খুব ছোট করেই বিশ্বকর্মা পুজো করা হবে। প্রতিমা শিল্পীদের বক্তব্য, ঠিক মতো কারখানা চলছে না। এবছর তাই প্রতিমার চাহিদা কমেছে। বেশিরভাগ জায়গায়ই কারখানা মালিকেরা ঘট পুজো করার কথা ভেবেছেন। গত বছর থেকে করোনা এবং লকডাউনের কারণে লোকাল ট্রেন চলাচল প্রায় বন্ধ। তার ফলে গ্রামের দিক থেকে শ্রমিক আসা কমে গেছে। ফলে কাটছাঁট করতে হয়েছে পুজোর বাজেটে। গত বছরের মত এই বছরেও অধিকাংশ কারখানায় মূর্তির আকার অনেকটাই ছোট হয়ে গেছে। এমনকী অনেক কারখানায় মূর্তির পরিবর্তে এবার ঘট পুজো করা হচ্ছে। কারখানার মালিকরা জানিয়েছেন, করোনা আবহে অর্ডার এবং পেমেন্ট ঠিক মত না আসার কারণে বেশ সমস্যায় পড়তে হচ্ছে তাঁদের। তাই তাঁরা এবার যা হোক করে পুজো সারবেন। এদিকে শিল্পের এই মন্দার প্রভাব পড়েছে মৃৎশিল্পেও। হাওড়ার প্রতিমা শিল্পীরা জানাচ্ছেন, ‘এবারে অনেক কম সংখ্যক বিশ্বকর্মা প্রতিমা তৈরির অর্ডার পেয়েছি। তাও সাইজে আবার ছোট। কাঁচামালের দাম বাড়লেও প্রতিমার দাম বাড়াতে পারছি না।’ এমন অবস্থায় বেশ সমস্যায় পড়েছেন মৃৎশিল্পীরা। হাওড়ায় ৬ নম্বর জাতীয় সড়ক থেকে বালি ব্রিজ, বেলিলিয়াস রোড থেকে বেলগাছিয়া জুড়ে রয়েছে ৬০-৭০ হাজার ছোট ছোট কলকারখানা। এক সময়ের ‘শেফিল্ড’ শিল্পনগরী হাওড়ার কারখানাগুলি চলত মূলত রেলের যন্ত্রাংশ, সেতু তৈরির উপকরণ, খনির যন্ত্রাংশ সরবরাহ করে।অথচ বছর চারেক আগেও ছবিটা অন্য রকম ছিল। ইছাপুর শিয়ালডাঙা, লিলুয়া, বেলগাছিয়া, বেলিলিয়াস রোড, কদমতলায় বিশ্বকর্মা পুজোর আগের দিন থেকে শুরু হয়ে যেত উৎসব। তারস্বরে বেজে চলা মাইকের শব্দে কান ঝালাপালা হয়ে যেত। আর এ বার? বৃহস্পতিবার, পুজোর আগের দিন গোটা শিল্পাঞ্চল ঘুরেও কানে আসেনি কোনও মাইকের আওয়াজ। নেই উৎসবের আমেজ। পুজোর আগের দিনও যেন ঝিমিয়ে রয়েছে গোটা শিল্পতালুক।বছর চারেক আগে থেকে এই সব যন্ত্রাংশ তৈরির বরাত কমতে থাকে। কম দামে এই সব যন্ত্রাংশ বহুজাতিক সংস্থাগুলি সরবরাহ করতে শুরু করায় মুখ থুবড়ে পড়ে হাওড়ার ছোট কলকারখানা। ফলে বরাতের অভাবে একে একে প্রচুর কারখানা বন্ধ হয়ে গিয়েছে। কারখানার ভবিষৎঅনিশ্চিত হয়ে যাওয়ায় অনেকে কাজ ছেড়েও দিয়েছেন। ফলে কোনও রকমে লড়াই করে টিকে থাকা কারখানাগুলিও দক্ষ শ্রমিকের অভাবে আজ ধুঁকছে।হাওড়া জেলার শিল্পের পরিস্থিতি নিয়ে মন্তব্য করতে গিয়ে মধ্য হাওড়ার বাসিন্দা শিল্পপতি সন্দীপ ঘোষ জানান, সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে প্রযুক্তিগত আধুনিককরণের পথে হাঁটেনি অধিকাংশ শিল্পগুলো। যার পরিণতিতে অন্যান্য নতুন প্রযুক্তির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে এঁটে উঠতে পারেনি এই শিল্প কারখানাগুলো। যদিও তিনি দাবি করেন ষাটের দশকের পর থেকেই হাওড়ার শিল্প নগরীর অবক্ষয় চালু হয়। যা সত্তর দশকের পড়ে আরো ত্বরান্নিত হতে হতে ইদানিং কালে একেবারে তলানিতে এসে ঠেকেছে। আর এভাবেই যদি চলতে থাকে তাহলে আগামী ২৫ বছরের মধ্যে হাওড়া শিল্প নগরী মৃত শিল্প নগরীতে রূপান্তরিত হবে বলেই দাবি করেন তিনি।পাশাপাশি হাওড়া চেম্বার অব কমার্সের আহ্বায়ক সঞ্জয় উপধ্যায়ের বক্তব্য বর্তমানে হাওড়ায় যে পরিমানে দক্ষ কারিগর পাওয়া যায়, তা ভারতের অন্য কোথাও আর পাওয়া যায় না । একটা সময় লাগাতার ধর্মঘট ও হরতালের জন্য ধীরে ধীরে শিল্প হাওড়া থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলেও বর্তমান সরকারের শিল্পনীতি ফলে পরিস্থিতি আগের থেকে অনেকটাই উন্নত হয়েছে । তবে শিল্পের অগ্রসরে সরকারের বিভিন্ন পরিকল্পনা নিলেও, বাস্তবে অনেকটাই খামতি থেকে যাচ্ছে।হাওড়ার ব্যবসায়ী সুশান্ত সিংহ দাবি করেন আগে পরিস্থিতি অন্যরকম ছিল। তাঁর কারখানাতেও শ্রমিকরা কাজ করতেন। এখন একাই সব কাজ করেন। ঈশ্বরকে ভালোবাসেন টাই পরিস্থিতির বাস্তবতাকে মেনে নিয়ে ঘট পুজো করবেন কারখানাতে।শহরের নবীন প্রতিমা শিল্পী হেমন্ত পাল সুদূর অতীতের কথা না বলে দু বছর আগের চিত্রের সঙ্গে যে ফারাক তৈরী হয়েছে সেটাই তুলে ধরেন। তিনি বলেন কোভিডের আগে তাঁরা প্রায় ১০০-১৫০ টি ঠাকুর বানাতেন। এখন হাতে গোনা ১০-১২ টি ঠাকুর তৈরী করছেন। কারখানা অধিকাংশ বন্ধ। বরাতও সেভাবে নেই। আর ঠাকুর তৈরী করে লাভের হার তলানিতে এসে ঠেকেছে।তবে একদা এই হাওড়ার শিল্প বিকাশে অন্যতম যোগসূত্র স্থাপন করেছিল ‘মার্টিন রেল ‘ যা হাওড়া শহরকে গ্রামীনা এলাকাকের সঙ্গে খুব সহজে যুক্ত করেছিল। পঞ্চাশ বছর চলার পর ১ জুলাই ১৯৫৫ এই লাইনে ট্রেন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। আর তার পর থেকেই ধীরে ধীরে যোগাযোগ ব্যবস্থায় পিছিয়ে পড়তে থাকে গ্রামীণ হাওড়ার শিল্পে সমৃদ্ধ জনপদগুলো।হাওড়া শিল্পাঞ্চল কবে কারিগরি দেবতা বিশ্বকর্মার আশীর্বাদে ফের ঘুরে দাঁড়াবে সেই আশায় দিন গুনছেন শ্রমিক ও প্রতিমা শিল্পীরা।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।